শনিবার, ১৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সমকালীন পুঁজিবাদের ত্রুটিগুলো কী?

অনেকটা আকস্মিকভাবেই পুঁজিবাদের নাজুক দশা দৃশ্যমান। সমাজতন্ত্রের ভাইরাস পুনরায় উজ্জীবিত হয়ে তরুণদের ফের প্রভাবিত করতে শুরু করেছে। প্রাজ্ঞতর মেধাবীরা, যারা কিনা পুঁজিবাদের বিগত অর্জনগুলোকে শ্রদ্ধাজ্ঞান করেন, তারা একে বাঁচাতে চাইছেন এবং বিভিন্ন ধরনের পথ্য ও প্রতিকারের প্রস্তাব রাখছেন। তবে তাদের প্রস্তাবনাগুলো কখনো পুঁজিবাদের বিপক্ষ যুক্তির সঙ্গে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, ফলে ডান-বামের ঐতিহ্যগত পার্থক্যগুলোকে তারা রীতিমতো হাস্যকর জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছেন।

এক্ষেত্রে সৌভাগ্যবশত রঘুরাম জি. রাজন—ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো বুথ স্কুল অব বিজনেসে শিক্ষকতা করছেন—তার অনন্য প্রজ্ঞা আর সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে ওই সমস্যাটি বিশ্লেষণ করেছেন। ‘দ্য থার্ড পিলার: হাউ মার্কেটস অ্যান্ড স্টেট লিভ কমিউনিটি বিহাইন্ড’ নামে তার নতুন বইয়ে তিনি যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, সমকালীন পুঁজিবাদের শরীরে ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধির আক্রমণ রাষ্ট্র (লিবিয়াথন) কিংবা বাজারের (বেহেমথ)  ব্যর্থতা নয়, এটি বরং কমিউনিটির পরাজয়। এখানে রূপক হিসেবে রাষ্ট্রকে কাল্পনিক অতিকায় সমুদ্র দানব ‘লিবিয়াথন’ এবং বাজারকে লৌহদানব ‘বেহেমথ’-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কমিউনিটি কিন্তু উল্লিখিত দুটি দানব অর্থাৎ রাষ্ট্র কিংবা বাজারের কোনোটাই নয়। রাজন তাই পথ্য হিসেবে কমিউনিটি পুনর্গঠনে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক স্থানিকতা’র কথা বলেছেন, যার মাধ্যমে মানুষকে আত্মসম্মান, পদমর্যাদা ও অর্থপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। রাজনের বইটি—যেমন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ পল কলিয়ারের ‘দ্য ফিউচার অব ক্যাপিটালিজম’ গ্রন্থটি—পুঁজিবাদের বন্ধুদের দ্বারা সমালোচনার একটি ক্রমবর্ধমান ধারার অংশ। পুঁজিবাদের সমর্থক হিসেবে রাজন স্বীকার করে নিয়েছেন, এটি এখন আর সামাজিক উন্নয়নের জন্য কাজ করে না, তাছাড়া একে এখন নিয়ন্ত্রণের সময় হয়েছে।

চলমান অবস্থাকে ব্যাখ্যা করার জন্য দ্য থার্ড পিলার গভীর ঐতিহাসিক প্রসঙ্গের অবতারণার প্রস্তাব পেশ করে, তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি যখন বিকাশের পুনর্গঠন ঘটায়, তখন ১৯৭০-এর দশকে সবকিছু কেন উন্মুক্ত হতে শুরু হলো, এটি তা ব্যাখ্যা করতে অনেক বেশি সফল হয়েছে। ততক্ষণ পর্যন্ত গোটা বিশ্ব ব্যস্ত ছিল পুনরুদ্ধার ও পুনর্নির্মাণ কাজে। তাছাড়া সে সময় পরিবর্তিত বিনিয়োগের মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বড় ধরনের গতি যোগ করে।

তবে ১৯৭০-এর পর থেকে প্রবৃদ্ধির গতি মন্থর হতে শুরু করে, যার নেপথ্যের কারণগুলো বর্তমান অনেক সমস্যার সঙ্গেই সংগতিপূর্ণ। সর্বোপরি যুদ্ধোত্তর হারিয়ে যাওয়া স্বর্গরাজ্যকে পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি প্রদান ছাড়া মন্থর প্রবৃদ্ধিকে কীভাবে চিহ্নিত করা যায়, সে সম্পর্কে সরকারগুলোর কোনো ধারণা ছিল না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেশগুলো অতিরিক্ত ঋণের বোঝায় আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া ইউরোপে অভিজাতরা রক্তপাতের পুনরাবৃত্তিমূলক পর্বগুলো বন্ধ করার মহান লক্ষ্য নিয়ে মহাদেশীয় ঐক্যকে অনুসরণ করেছে। সংহতি স্থাপনের সুবিধাগুলো নিশ্চিতের তাড়াহুড়োয় তারা তাদের নাগরিকদেরই সঙ্গে নিয়ে আসতে ভুলে গেছে। যদিও তারা শিখেছে যে ঔদ্ধত্যের উপযুক্ত শাস্তি হয়।

যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সামাজিক গণতন্ত্রের সাফল্য রাষ্ট্রের ওপর বাজারের প্রভাবগুলোকে দুর্বল করে দেয়। রাজনের মতে, ইউরোপ ও আমেরিকায় উভয় দেশেই কমজোর ব্যবসায়ীরা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিপ্লব মোকাবেলার মতো উপযুক্ত অবস্থায় ছিলেন না, ফলে সাধারণ মানুষকে তারা নিজেদের হুমকির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন। নিজেদের কর্মীদের এ বাধা অতিক্রমে সাহায্য করার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালকদের আরো বেশি সমৃদ্ধিশালী করতে কর্মীদের দুর্বলতাগুলো কাজে লাগিয়ে বিষয়টিকে আরো বেশি সংকটাপন্ন করে তোলে।

যদি জানতে চাওয়া হয়, সমৃদ্ধিশালী হওয়ার প্রক্রিয়াটি কীভাবে সম্পাদিত হয়? মাঝারি পরিবারগুলোর আয় বেশির ভাগই অপরিবর্তনশীল, তবে ক্রমবর্ধমান শেয়ারের মাধ্যমে সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে, এভাবে জনপ্রিয় সমর্থকদের হারিয়ে পুঁজিবাদ স্পষ্টত অন্যায্য হয়ে ওঠে। প্রতিপক্ষকে সামলাতে গিয়ে লৌহদানব বেহেমথ ডেকে আনে সমুদ্রদানব লিবিয়াথনকে, যদিও সে তখন উপলব্ধি করতে পারে না যে দিন শেষে ডানপন্থী লোকরঞ্জনবাদী লিবিয়াথন তাকে গলাধঃকরণ করে নেবে।

রাজনের গল্পে দুটো বিষয়ে জোর দেয়া দরকার। প্রথমত, প্রবৃদ্ধির বিষয়টি অস্বীকার করাটা এক্ষেত্রে সহায়ক, যদিও এটি কম বণ্টনমূলক এবং আজকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণও। দ্বিতীয়ত, তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য নয়। রাজন তার বইয়ে যেমন উল্লেখ করেছেন, ‘তারা বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাষ্ট্র ও বাজারগুলোর ব্যর্থতাকে তুলে ধরে বা প্রতিফলিত করে।’

রাজন জোর না দিলেও দ্বিতীয় বিষয়টি অবশ্য আমাদের আশার কারণ হয়ে আসে। অর্থাৎ আইসিটি আমাদের একটি কর্মসংস্থানহীন ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেবে না; বরং কার্যকর নীতিমালা তৈরি এখানে কল্যাণকর ভূমিকা রাখতে পারে।

রাজন করপোরেটদের কদাচারকে খুব ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন, তাছাড়া বিখ্যাত বিজনেস স্কুলের একজন প্রফেসরের পক্ষ থেকে এমন বিষয়ের অবতারণাও দারুণ ব্যাপার। শুরুতে শেয়ারহোল্ডারদের প্রাধান্য সম্পর্কিত কাছাকাছি স্বৈরতান্ত্রিক তত্ত্বের মধ্যে রয়েছে কর্মীদের অর্থ কোম্পানির পরিচালকদের রক্ষার জন্য ব্যয় করার বিষয়টি, ক্ষতিকর প্রভাবের মাত্রা আরো বেশি বিস্তৃত হয় যখন বেতনের বদলে কোম্পানির ব্যবস্থাপকদের মালিকানা দেয়া হয়।

দ্য ফিউচার অব ক্যাপিটালিজম বইয়ে পল কলিয়ার ব্রিটেনের একটি সমান্তরাল অর্থসংক্রান্ত বিররণ তুলে ধরেছেন। সেখানে তিনি তার (এবং আমারও) শৈশবের সবচেয়ে প্রশংসিত ও জনপ্রিয় ব্রিটিশ কোম্পানি ইম্পেরিয়াল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের (আইসিআই) গল্প বলেছেন। বেড়ে ওঠার সময় আমরা প্রত্যেকেই আইসিআইয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখতাম, কোম্পানিটির লক্ষ্য ছিল ‘বিশ্বের সবচেয়ে মানসম্পন্ন কেমিক্যাল কোম্পানির খেতাব অর্জনের’। তবে ১৯৯০-এর দশকে কোম্পানিটি তার প্রাথমিক লক্ষ্যগুলোয় সংশোধন এনে শেয়ারহোল্ডারদের প্রাধান্য দিতে শুরু করে। এ প্রসঙ্গে কলিয়ার বলেছেন, প্রাথমিক ওই একটি পরিবর্তনই কোম্পানিটির ধ্বংসের কারণ হয়ে আসে।

কমিউনিটি সেবার ক্ষেত্রে কী ঘটেছে? সর্বজনীন শিক্ষার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র একসময় গোটা বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করত, আঞ্চলিক পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে সব শ্রেণীর পরিবারের ছেলেমেয়েদের একই পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিত। যেখানে পরিবারের আর্থিক অবস্থানের বিষয়টিও উহ্য থাকত। যখন কিনা প্রাথমিক শিক্ষার এ ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত বলে মনে হলো, নাগরিক সেবা কেন্দ্রগুলো তখন সবার জন্য মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় আগ্রহী হয়ে উঠল।

আজকাল যখন একটি কলেজ ডিগ্রি সাফল্যের পূর্বশর্ত হয়ে উঠেছে, তখন মেধাবী শিক্ষার্থীরা কমিউনিটির বাইরের প্রতিষ্ঠানমুখীন হয়ে দ্রুতবর্ধনশীল শহরগুলোয় ছড়িয়ে পড়ছে, যেখানে কিনা ব্যয়বহুল জীবনযাত্রার খরচের জন্য কম মেধাবীরা বাদ পড়ে যাচ্ছে। আকর্ষণীয় স্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ধীসম্পন্ন ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় আয়ত্ত করতে যারা সফল হয়, তারা এবং পরবর্তীতে তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মই সাধারণত উতরে যায়।

ব্রিটেন সম্পর্কে কলিয়ার একই ধরনের একটি গল্প বলেছেন। লন্ডন, যেখানে মেধা ও জাতীয় আয়ের বণ্টন ক্রমে কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে এবং  বিক্ষুব্ধ সম্প্রদায়গুলোকে শহরের বাইরে ফেলে রাখা হয়েছে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের জনন গণেশ উল্লেখ করেছেন, এ ধরনের মহানগরীর অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা নিজেদের গণ্ডির মধ্যেই শৃঙ্খলিত।

নিজের লেখায় রাজন অবশ্য গুণতন্ত্রকে তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের একটি পণ্য হিসেবে অভিহিত করেছেন। তবে আমি মনে করি, বিষয়টির সূত্রপাত তারও আগে। তাছাড়া ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী মিশেল ইয়ং তার ভবিষ্যত্দর্শী ডাস্টোপিয়া (নিপীড়িত, সন্ত্রাসী ও অপ্রীতিকর সমাজ ব্যবস্থা) হিসেবে ১৯৫৮ সালে ‘দ্য রাইজ অব দ্য মেরিটোক্রেসি’ বইটি প্রকাশ করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে আমি এবং পল কোলার কিন্তু প্রথম দিককার ব্রিটিশ গুণতন্ত্রীদের মধ্যে পড়ি। ঠিক যেমন ইয়ং ধারণা করেছিলেন, তবে আমাদের দলটি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তৈরি ব্যবস্থাটি ভেঙে দিয়েছে, যদিও এর গুণাবলি নিয়ে উচ্চ প্রশংসা জারি রয়েছে।

স্কটল্যান্ড, যেখানে আমি বেড়ে উঠেছি, সেখানে স্থানীয় সম্প্রদায়ের প্রতিভাবান লোক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, ইতিহাসবিদ ও শিল্পী সবাইকে আরো বৃহৎ সুযোগের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল অথবা বাজারের তথাকথিত সফল সুপারস্টারের বিপরীতে প্রতিযোগিতায় নামার আশা ছেড়ে দিতে হয়েছিল। আমরা এখন আরো বেশি অসহায়।

তাই রাজনের মতোই আমি মনে করি, একসঙ্গে বাজার ও রাষ্ট্রকে আয়ত্ত করার জন্য সংখ্যালঘু অভিজাত সম্প্রদায়ের জন্য কমিউনিটি একটি দুর্ঘটনা। কিন্তু বিপরীতভাবে আমি সন্দেহ পোষণ করি যে শক্তিশালী স্থানীয় সম্প্রদায় কিংবা স্থানিকতার নীতি (অন্তর্ভুক্তিমূলক কিংবা নয়) আমাদের অসুস্থতাগুলোকে কতটা নিরাময় করতে পারবে। তাছাড়া গুণতন্ত্রের দানবকে তো বোতলবন্দি করা সম্ভব নয়।

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

 

লেখক: নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ

প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক

ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস

সূত্র :বনিক বার্তা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category